SDN বাংলা : জীবনের জন্য, জীবনের সফলতার জন্য এবং মানবসভ্যতার বিকাশের জন্য প্রয়োজন বই। বই পড়তে হবে, বই লিখতে হবে এবং বইয়ের সঙ্গে করতে হবে মিতালি। বই আমাদের জীবনের পরম বন্ধু। বই পড়লে জীবনের পরতে পরতে এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। বই পড়ার উপকারিতা তথা বই পড়লে আমাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়, সেগুলো হলো -
এক. বই পাঠকের মানসিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অধ্যয়ন ডিমেন্সিয়া ও আলজেহিমা নামের এই রোগ দুটিকে হ্রাস, এমনকি প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে। মস্তিষ্ককে সচল রাখলে তা কখনোই তার ক্ষমতা হারাবে না। মস্তিষ্ককে শরীরের একটি সাধারণ পেশি হিসাবে বিবেচনা করে বই পড়া চর্চার মাধ্যমে নিয়মিত ব্যায়াম করলে তা শক্তিশালী ও সজীব থাকে।
দুই. বই পড়লে পাঠকের মানসিক চাপ হ্রাস পায়। অনেকে তাদের মানসিক চাপ কমাতে ব্যায়ামের আশ্রয় নেয়, কেউ কেউ আবার যোগব্যায়াম করে থাকেন। কিন্তু মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে ভালো বই পাঠ করলে তারা মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন করতে পারেন। বই পড়ার মজা হচ্ছে এটি একজন মানুষকে মুহূর্তের মধ্যেই কোনো এক অজানা জগতে নিয়ে যায় কিংবা এমন কোনো সময়ে ভ্রমণ করায়, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, ‘বই পড়াকে যথার্থ হিসাবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ-কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’
তিন. বই পড়লে মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়। জনাথন সুইফট বলেছেন, ‘বই হচ্ছে মস্তিষ্কের সন্তান’। গবেষকরা বলেন, বই পড়লে মস্তিষ্কের জটিল কোষগুলো উদ্দীপিত হয় এবং স্নায়ুগুলো উজ্জীবিত হতে থাকে। পড়ার সময় পাঠকের মস্তিষ্ক ভিন্ন জগতে বিচরণ করে এবং পঠিতব্য বিষয়ের প্রতি সে মনোনিবেশ করতে পারে। এভাবে বইয়ের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নানাবিধ বিচরণের কারণে পাঠকের মানসিক চর্চা বৃদ্ধি পায়।
চার. বই পড়লে শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয় এবং শব্দচয়ন ও বাক্য বিন্যাসের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। যত বেশি বই পড়া হয়, তত বেশি শব্দভান্ডারে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ যোগ হতে থাকে। ফলে বই পড়া শব্দভান্ডার সমৃদ্ধিতে অনেক বেশি সাহায্য করে। নতুন কোনো ভাষা শিখতেও বই পড়ার বিকল্প নেই। এটি খুব দ্রুত নতুন যে কোনো ভাষাকে আয়ত্ত করতে সহায়তা করে। বই পড়ার মাধ্যমে অনেক অজানা শব্দ আয়ত্ত করা যায়, যা পাঠকের প্রাত্যহিক কথোপকথনে কাজে লাগে।
পাঁচ. বই পড়লে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। যে কোনো বই পড়ার সময় পাঠককে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে বিষয়ভিত্তিক তথ্যসূত্র মনে রাখতে হয়। যেমন কেউ গল্পের বই পড়লে তাকে গল্পের বিভিন্ন চরিত্র, ইতিহাস, পটভূমি, গল্পের উদ্দেশ্য, উপ-খণ্ড ইত্যাদি ধারাবাহিকভাবে মনে রাখতে হয়। এ তথ্যভান্ডার আমাদের কাছে বোঝা মনে হলেও মস্তিষ্কের অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে সবকিছু মনে রাখার। প্রতিটি নতুন স্মৃতি একটি নতুন সাইন্যাপ্স (Synapse) তৈরি করে বিদ্যমান স্মৃতিকে আরও শক্তিশালী করে এবং স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিকে আরও উন্নত করে।
ছয়. বই পড়লে বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাশক্তি উন্নত হয়। যে কোনো বই রচিত হয় কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এবং তাতে তথ্য-উপাত্তের ব্যাপক সন্নিবেশ থাকে, যা পাঠককে জ্ঞান আহরণে ও চিন্তাশক্তির উন্নয়নে সাহায্য করে। ঘটনার বিবরণ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা আবিষ্কারের ক্ষেত্র ও সূত্র ইত্যাদি সম্পর্কে নানাবিধ বিশ্লেষণ থাকে বইয়ে, যা পড়লে পাঠকের মধ্যেও এক ধরনের চিন্তাশক্তি জাগ্রত হয় এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
সাত. বই পড়লে পাঠকের লিখন ও পঠন দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। পাঠক যে বইটি পড়ছেন সেটি মূলত ওই বইয়ের লেখকের বিশেষ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা। সেই জ্ঞান পাঠকের জ্ঞানের পরিধিকে বৃদ্ধি করে তার সফলতাকে ত্বরান্বিত করতে পারে। বিভিন্ন বইয়ে দেখা যায় লেখক তার জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করে এবং সেই ব্যর্থতা থেকে কীভাবে কী উপায়ে তিনি উপরে উঠতে থাকেন, সেই বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ থাকে বইয়ে। সেই লেখা বা গল্প থেকে জানতে পারা যায় কোন পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করলে সফলতা নিশ্চিত হয় এবং ভুলের সম্ভাবনাও কমে আসে।
আট. বই পড়লে কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতার জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। বই পাঠককে এক কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যায় এবং তাকে ভাবাতে শেখায় পৃথিবীতে কোনো কিছু অসম্ভব নয়। বই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সহজেই আবিষ্কার করার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বই যেন এক বিশাল মাকড়শার জাল, যা সবকিছুকেই একসূত্রে গেঁথে দেয়, পাঠকের জানা বিষয়ের সঙ্গে নতুন আবিষ্কৃত বিষয়কে জোড়া লাগিয়ে নতুন এক উত্তর কিংবা সমাধান বের করা যেন বইয়ের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। বইয়ের মাধ্যমে পাঠক সৃষ্টিশীল চিন্তার এক অপার রাজ্যে বসবাস করতে সক্ষম হয়। অসাধ্যকে সাধন করার এক মহান দীক্ষা সে পেতে পারে বই থেকে।
নয়. বই আত্মার প্রশান্তি জোগায়। বই পড়তে হয় মনের আনন্দের জন্য। মনের মধ্যে কোনো অশান্তি থাকলে কোনো এক নিরিবিলি জায়গায় কোনো এক পছন্দের বই নিয়ে গেলেই পাঠকের আত্মায় প্রশান্তি আসবে। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মুক্ত বাতাস ওই পাঠকের চিন্তাকে যেন আরও প্রসারিত করবে, যা কখনোই লাইব্রেরিতে বসে পড়ার মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়। কিছুক্ষণের বই পড়া তার সারা দিনের ক্লান্তিকে নিমিষেই দূর করে দেবে। ফ্রাঙ্কস কাফকা বলেছেন, ‘আমাদের আত্মার মাঝে যে জমাট বাঁধা সমুদ্র, সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙার কুঠার হলো বই।’
দশ. বই যুগসই প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি করে। বই হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির আধার। প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞানচর্চা করতে বইয়ের বিকল্প নেই। মানুষ যত বই পড়বে, বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তত বেশি তাল মেলাতে পারবে। বই হলো আন্তর্জাতিক যোগাযোগের এক অন্যতম মাধ্যম। এ মাধ্যমে মানুষ নিজেকে উন্নত বিশ্বের অত্যাধুনিক টেকনোলজির সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করে আধুনিক কলাকৌশল ও যুগসই প্রযুক্তিতে পারদর্শী করে তুলতে পারে।
এগারো. বই পাঠকের মধ্যে পাঠাভ্যাস সৃষ্টি করে। বই না পড়ার মানসিকতা মানুষকে দিন দিন পাঠবিমুখ করে ফেলছে। ফলে তাদের মধ্যে বই পড়া বা বই কেনার আগ্রহ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। মানুষকে এখন সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটির সম্মুখীন হতে হয় তা হলো মনোযোগের অভাব। মানুষ যত বেশি বই পড়বে, তার মধ্যে তত বেশি জ্ঞানের তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাবে এবং বই পড়ার প্রতি তার মনোযোগ আকৃষ্ট হবে। মার্ক টোয়েন বলেছেন, ‘বই পড়ার অভ্যাস নেই আর পড়তে জানে না এমন লোকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’
বারো. বই যোগাযোগ দক্ষতা ও বাচনভঙ্গি উন্নত করে। যারা বই পড়েন তারা খুব সহজেই অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। তারা জানেন কোন পরিস্থিতিতে কী কথা বলতে হয় এবং কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়। ভার্বাল ও নন ভার্বাল কমিউনিকেশনে বইয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যারা বই পড়ে না তারা অনেক বিষয়েই সচেতন নয়। বই পড়লে কথা বলার ধরন, বাচনশৈলী, শব্দচয়ন পদ্ধতি ও প্রকাশভঙ্গি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। সমাজে চলতে গেলে যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বই পড়া যেমন জ্ঞানের পরিধি বিস্তারে সাহায্য করে, তেমনি নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করার কৌশল জানতে সহায়তা করে। বই পারে মানুষকে পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করতে। দেকার্তে বলেছেন, ‘ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর সেরা মানুষদের সঙ্গে কথা বলা।’ এভাবে বই মানুষের যোগাযোগ ক্ষমতাকে উন্নত করে এবং জ্ঞানী মানুষদের সঙ্গে একটি সংযোগ স্থাপন করে।
যেহেতু বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়, সেহেতু বই-ই হতে পারে আমাদের জীবনের একনিষ্ঠ বন্ধু এবং এর সঙ্গে বন্ধুত্ব ও মিতালি করা যায়। বই কিনে ও বই পড়ে আমরা আমাদের জীবনের গতিপথ বদলাতে পারি এবং উঠতে পারি উন্নতির চরম শিখরে। এজন্য প্রয়োজন আমাদের সন্তানদের পর্যাপ্ত বই কিনে দিয়ে তাদের বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত সভ্যতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায়, ‘বই কিনে কেউ কোনোদিন দেউলিয়া হয় না।’ ভলতেয়ার বলেছেন, ‘সে দেশ কখনো নিজেকে সভ্য বলে প্রতীয়মান করতে পারবে না, যতক্ষণ না তার বেশিরভাগ অর্থ চুইংগামের পরিবর্তে বই কেনার জন্য ব্যয় হবে।’ ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত উক্তিটি বইয়ের গুরুত্ব বোঝার জন্য অসাধারণ; তিনি বলেছেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ সুতরাং, বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি। আমরা বই কিনব, পড়ব, লিখব এবং অন্যকে বই পড়তে উৎসাহিত করব।
ড. মো. মাহমুদুল হাছান : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক


0 Comments